অণু গঠনের নতুন কৌশল উদ্ভাবনে রসায়নের নোবেল
নতুন ধরনের অনুঘটক ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে অনু গঠনের কৌশল উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে ওষুধ শিল্পের জন্য নতুন দুয়ার উন্মোচনের স্বীকৃতিতে চলতি বছর রসায়ন শাস্ত্রের নোবেল পেয়েছেন দুই বিজ্ঞানী।
রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস বুধবার এ পুরস্কারের জন্য জার্মান বিজ্ঞানী বেনিয়ামিন লিস্ট এবং ব্রিটিশ গবেষক ডেভিড ম্যাকমিলানের নাম ঘোষণা করে।
নোবেল কমিটি বলছে, অ্যাসিমেট্রিক অরগানোক্যাটালিস্ট নামে যে অনুঘটক তারা তৈরি করেছেন, তা ব্যবহার করে একটি অণুর হুবুহু প্রতিরূপ তৈরি করা যায়।
এই দু’জনের দেখানো পথই নতুন শতাব্দীতে পা পড়ার পর থেকে অত্যন্ত কার্যকরী নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কারের দরজাটা হাট করে খুলে দিয়েছে সভ্যতার সামনে। তারই স্বীকৃতিতে জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর কোহলেনফরশুং-এর অধিকর্তা অধ্যাপক লিস্ট ও আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাকমিলানকে পুরস্কৃত করার কথা বুধবার নোবেল কমিটি ঘোষণা করেছে। জানিয়েছে, ১ কোটি সুইডিশ ক্রোনার অর্থমূল্যের পুরস্কার এ বার লিস্ট ও ম্যাকমিলানের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
অন্য পথ খুঁজছিলেন দু’জনেই
দু’জনেই এমন পথ খুঁজেছিলেন যাতে নির্ঝঞ্ঝাটে, যেমনটি চাইছি ঠিক সেই ভাবেই দু'টি জৈব অণুর মধ্যে জোড় বাঁধিয়ে কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়াকে নিজেদের ইচ্ছেমতো গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যাতে চাইলে সেই বিক্রিয়ার গতি বাড়বে। না চাইলে কমানোও যাবে ইচ্ছে মতোই। যে কাজটা প্রকৃতি করে চলে অনায়াসে, অনবরত মানবশরীরে। মানবশরীরকে বলে দিতে হয় না, শেখাতে পড়াতে হয় না, কখন কোন প্রোটিন বা উৎসেচক প্রয়োজন হবে জীবন-রথের চাকাকে তরতরিয়ে গড়িয়ে নিয়ে যেতে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, এই কাজটাই যদি আমরা করতে পারি তা হলে তো জীবনদায়ী-সহ যে কোনও ওষুধ তৈরির কাজটা অনেক সহজ হয়ে যেতে পারে। যা চাইছি যেমন চাইছি যে গতিতে চাইছি, সেই ভাবে ওষুধ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলিকে ঠিক সেই ভাবে তো ঘটতে দেয় না বাতাসের আর্দ্রতা (জলের উপস্থিতি) আর অক্সিজেনই।
অনুঘটক: প্রকৃতি, মানবশরীর
অথচ, প্রকৃতি গোড়া থেকেই এই সব লক্ষ লক্ষ ‘হাতিয়ার’ তৈরি করে রেখেছে মানবশরীরে। যাদের কাজকর্মের গতি বাতাসের আর্দ্রতা আর অক্সিজেন কমাতে-বাড়াতে পারে না। এরা অনায়াসেই নিজের নিজের খেয়ালে কখনও কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি বাড়িয়ে আমাদের জীবনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে। কখনও বা গতি কমিয়ে। এদের আমরা বলি অনুঘটক (‘ক্যাটালিস্ট’)। আর তাদের সেই কাজকর্মের প্রক্রিয়াটার নাম অনুঘটন প্রক্রিয়া (‘ক্যাটালিলিস’)।
শুধুই শরীরে নয়, আমাদের রোজকার জীবনযাত্রাতেও এমন নানা ধরনের অনুঘটকের প্রয়োজন হয়। দিনগুলিয়ে চালিয়ে নিয়ে যেতে। রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি বাড়ানো আর কমানোর নিরিখে যথাক্রমে দু’ধরনের অনুঘটক হয়। ধনাত্মক অনুঘটক (‘পজিটিভ ক্যাটালিস্ট’) আর ঋণাত্মক অনুঘটক (‘নেগেটিভ ক্যাটালিস্ট’)। মাথায় রাখা জরুরি, গোটা বিশ্বের মোট গৃহজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর ৩৫ শতাংশই নির্ভর করে রাসায়নিক অনুঘটন প্রক্রিয়ার উপর। যেহেতু তাদের উপরেই নির্ভরশীল ওষুধ-সহ যাবতীয় শিল্পপণ্যের উৎপাদন।
ধারণায় কোথায় ঘা মেরেছিলেন লিস্ট ও ম্যাকমিলান?
লিস্ট ও ম্যাকমিলান- দু’জনেই অনুঘটক আর অনুঘটন প্রক্রিয়া সম্পর্কে কয়েক শতাব্দীর প্রচলিত ধারণায় সজোরে ধাক্কা মেরেছিলেন। জানিয়েছিলেন, গত শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত আমাদের যা ধ্যানধারণা ছিল, সেই ধাতু আর মানবশরীরের লক্ষ লক্ষ উৎসেচক (‘এনজাইম’) ছাড়াও অন্য অনুঘটকের অস্তিত্ব সম্ভব। যা মানবশরীরের লক্ষ লক্ষ উৎসেচকের প্রায় সমান দক্ষতায় কাজ করতে পারে। বিক্রিয়ার গতি আমরা যেমন চাইছি, সেই মতো কমিয়ে-বাড়িয়ে প্রয়োজন মাফিক ঠিক সেই সেই জৈব অণু তৈরি করতে পারে। তাতে কাঙ্ক্ষিত জৈব অণুকে পাওয়ার জন্য রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলির ধাপের সংখ্যাও কমানো যায়। বিক্রিয়াগুলির ধাপ কমে বলে সে ক্ষেত্রে মাঝের ধাপগুলির অপ্রয়োজনীয় জৈব অণুগুলি তৈরি হতেই পারে না। যার পরিণতিতে কাঙ্ক্ষিত জৈব অণুর পরিমাণ বাড়ে। ওষুধ আবিষ্কার ও তৈরি করে যারা তাদের জন্য যা খুবই জরুরি। তাতে তাদের খরচ বাঁচে। পরিবেশের পক্ষে বিপজ্জনক উপজাতও তৈরি হয় না বলে বাঁচে পরিবেশও। ওষুধও হয় খুব নিখুঁত। আরও বেশি কার্যকরী।
ধাতব অনুঘটক ও অরগ্যানোক্যাটালিসিস
২০০০ সালে আলাদা আলাদা ভাবে করা দু’টি গবেষণায় নতুন শ্রেণির সেই অনুঘটকেরই খোঁজ দিয়েছিলেন লিস্ট ও ম্যাকমিলান। যা আমাদের পরিচিত ধাতব অনুঘটক নয় পুরোদস্তুর। আবার মানবশরীরের লক্ষ লক্ষ উৎসেচকের মতো অনুঘটকও নয়। এই নতুন শ্রেণির অনুঘটকের নামটা প্রথম দিয়েছিলেন অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকমিলান। ‘অরগ্যানোক্যাটালিস্ট্স’। প্রক্রিয়াটার নাম- ‘অরগ্যানোক্যাটালিসিস’।
এই নতুন শ্রেণির অনুঘটকরা আদতে জৈব অণু। চার হাতের (‘ভ্যালেন্সি’) কার্বন পরমাণুর জৈব যৌগ। যার শৃঙ্খলগুলি খুব দীর্ঘ। তাদের কোনও হাতে ধরা থাকতে পারে অক্সিজেন পরমাণু, কোনও হাতে হাইড্রোজেন বা কোনও হাতে নাইট্রোজেন পরমাণু। এই সব পরমাণুই যেহেতু খুব সহজলভ্য তাই নতুন নতুন ওষুধ তৈরির জন্য রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো এগিয়ে নিয়ে যেতে অসুবিধা হয় না ওষুধ সংস্থাগুলির।
আবার ধাতব অনুঘটক ব্যবহারের বিস্তর হ্যাপাও সামলাতে হয় না তাদের। যেহেতু ধাতু বাতাসের আর্দ্রতা আর অক্সিজেন পেলেই অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তুতে পরিণত হতে পারে। তা ছাড়াও বেশির ভাগ ধাতব অনুঘটকই তৈরি হয় ভারী ধাতু দিয়ে। যা পরিবেশের পক্ষে বিপজ্জনক।
তাদের উদ্ভাবিত ওই কৌশল অনেক নতুন ওষুধ তৈরির পথ খুলে দিয়েছে। সেই সাথে নতুন অণু তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, যা সৌরবিদ্যুতের সেল তৈরিতে কাজে লাগে।
অনেক শিল্পেই পণ্যের মানোন্নয়নের বিষয়টি নির্ভর করে নতুন ও কার্যকর উপাদান তৈরি করতে পারার ওপর। সেটা টেকসই ও হালকা নতুন জুতা তৈরির জন্যই হোক, কিংবা সূর্যের আলো থেকে শক্তি ধরে রাখতে পারে এমন ব্যাটারি তৈরির জন্য। ল্যাবরেটরিতে নতুন উপাদান তৈরির সেই কাজটা করেন কেমিস্টরা।
ওষুধ তৈরির জন্য তাদের প্রায়ই এমন নতুন অণু তৈরি করতে হয়, যেগুলো গঠনগতভাবে হবে একটি আরেকটির হুবুহু প্রতিরূপ বা মিরর ইমেজ, কিন্তু বৈশিষ্ট্য হবে আলাদা। লিমোনিন হল এরকম একটি অণু, যার একটি থেকে লেবুর গন্ধ পাওয়া যায়, কিন্তু ঠিক তার প্রতিরূপই কমলার গন্ধের অনুভূতি জাগায়।
অর্থাৎ, দুটো মলিকিউল বা অণু গাঠনিকভাবে হুবুহু একরকম হলেও আমাদের শরীর ওই দুটোকে আলাদাভাবে চিনতে পারে। ওষুধের ক্ষেত্রেও তাই হয়।
কিন্তু ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে ওই মিরর ইমেজ তৈরি করার কাজটি অত্যন্ত জটিল, যা শরীরে কেবল কাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলবে।
রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে সঠিক অনুঘটক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। একসময় ধারণা করা হত, অনুঘটক হয় শুধু দুই ধরনের। একটি হল ধাতব, অন্যটি প্রাণীর শরীরের এনজাইম।
বিজ্ঞানী বেনিয়ামিন লিস্ট এবং ডেভিড ম্যাকমিলান সম্পূর্ণ আলাদা গবেষণায় তৃতীয় এক ধরনের অনুঘটক তৈরি করেন, যা হল এই অ্যাসিমেট্রিক অরগানোক্যাটালিস্ট। যার ফলে ওই মিরর ইমেজ মলিকিউল তৈরি করা অনেক সহজ হয়ে গেল।
নোবেল কমিটির ভাষায়, তাদের এই উদ্ভাবন নতুন অণু তৈরির কেমেস্ট্রিকে অন্য স্তরে নিয়ে গেছে। এই কৌশল একদিকে যেমন সশ্রয়ী, অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর কোলেনফরশুংয়ের পরিচালক বেনিয়ামিন লিস্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকমিলান দুজনেরই বয়স এখন ৫৩ বছর। তারা একই সময়ে অ্যাসিমেট্রিক অরগানোক্যাটালিস্ট নিয়ে গবেষণা করেছেন, যদিও শুরুতে তারা অন্যজনের কাজের বিষয়ে জানতেন না।
এবারের নোবেল পুরস্কারের এক কোটি সুইডিশ ক্রোনার সমানভাগে ভাগ করে নেবেন এ দুই গবেষক।
জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে ডিএনএ সম্পাদনার ‘সূক্ষ্মতম’ কৌশল উদ্ভাবনের স্বীকৃতিতে জার্মানির গবেষক ইমানুয়েল কার্পেন্টার এবং যুক্তরাষ্ট্রের জেনিফার এ ডাউডনার গতবছর রসায়ন শাস্ত্রের নোবেল পান।
বরাবরের মতই চিকিৎসা বিভাগের পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সোমবার চলতি বছরের নোবেল মৌসুম শুরু হয়। মানবদেহে উষ্ণতার অনুভূতি কীভাবে ছড়ায়, সেই গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গবেষক ডেভিড জুলিয়াস ও অডার্ম প্যাটাপুটেনকে এবার যৌথভাবে চিকিৎসার নোবেল জিতেছেন।
No comments:
Post a Comment
Your Comments help us a lot