ভগৎ সিং একজন মনোযোগী পড়ুয়া ছিলেন! একথা আপনি জানেন? - EVERY THINK - SUDIPTA SAMANTA

EVERY THINK - SUDIPTA SAMANTA

We provide you the best study material, Lecture video series, PDF books and notes for class XI, XII, WBJEE, NEET, IIT-JEE, B.Sc, M.Sc chapter wise.

Breaking News

WELCOME TO MY WEBSITE "EVERY THINK" AND SEE SOMETHING NEW

Post Top Ad

Post Top Ad

Free Study Material Download From Here

Wednesday, June 16, 2021

ভগৎ সিং একজন মনোযোগী পড়ুয়া ছিলেন! একথা আপনি জানেন?

 ভগৎ সিং একজন মনোযোগী পড়ুয়া ছিলেন

Born: September 1907, Banga, Pakistan


বড়মাপের বিপ্লবী হতে হলে যেমন চাই যে কোনাে অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে সংগঠন গড়ে তােলার অপরিসীম ক্ষমতা , তেমনি থাকা চাই এমন একটা আদর্শ যা কিনা শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে বঞ্চনামুক্ত সমাজ গড়ে তােলার সঠিক পথ দেখাতে পারে । সকলেই জানেন , সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী শহীদ সর্দার ভগৎ সিং ছিলেন অশেষ সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী । ভারতের শ্রমজীবী মানুষকে ভগৎ সিং সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখান , ভারতের বুকে সাথীদের নিয়ে তিনিই প্রথম ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দেন । ২৪ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৩১ সালের ২৩ শে মার্চ যাঁকে ব্রিটিশরাজের ফাঁসির মঞ্চে শহীদ হতে হলাে , তারপক্ষে ওই সময়ে এমন একটা আদর্শকে গ্রহণ করা , এমন একটা স্লোগান দেওয়াটা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না । তাহলে এই ঐতিহাসিক কাজটি ভগৎ সিংয়ের পক্ষে কীভাবে করা সম্ভব হলাে ? পারিবারিক পরিমণ্ডল , জীবনবােধ , দেশের প্রতি ভালবাসা , পরাধীন দেশবাসীর জন্য অসীম দরদ , সাথীদের সাহচর্য , কয়েকজন বিপ্লবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক , কিছু ঘটনা- এসব যেমন ভগৎ সিংকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে এক অসাধারণ বিপ্লবী হয়ে উঠতে , তেমনি পাশাপাশি তাঁর আদর্শের ভিত্তিভূমি গড়ে তুলতে বিপুলভাবে সাহায্য করেছে নানা ধরনের প্রগতিশীল বই , সাময়িকপত্র , সংবাদপত্র ।

সত্যি কথা বলতে কী , শহীদ ভগৎ সিংয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে যতটা আলাপ - আলােচনা হয় , প্রায় ততটাই অনালােচিত থেকে যায় তাঁর পড়াশােনার কথা । ভগৎ সিং ছিলেন এক অনন্য সাধারণ একনিষ্ঠ এবং মনােযােগী পড়ুয়া । তাঁর জীবনচর্চা অন্তত সেকথাই প্রমাণ করে । 


গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শ্রেণীর পাঠ সফলভাবে সাঙ্গ করার পর তাঁর বাবা সর্দার কিষেন সিং উচ্চতর পড়াশােনার জন্য ভগৎ সিংকে লাহােরে পাঠান । আর্যসমাজীদের ডি এ ভি স্কুল ছেড়ে বিখ্যাত স্বাধীনতা - সংগ্রামী লালা লাজপত রাইয়ের প্রতিষ্ঠা করা লাহােরের ন্যাশনাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ভগৎ সিং ক্রমশ হয়ে ওঠেন প্রগতিশীল বইপত্রের একজন অত্যন্ত মনােযােগী পড়ুয়া । ১৭/১৮ বছর বয়সের এক তরুণ তখন ভগৎ সিং । ন্যাশনাল কলেজের লাইব্রেরি আর লালা লাজপত রায়ের সহকর্মী স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা দ্বারিকা দাসের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত লাহােরের দ্বারিকা দাস লাইব্রেরি ভগৎ সিংয়ের বইপত্র পড়ার অভ্যাসটি গড়ে তুলতে বিশেষভাবে সাহায্য করে । আদালতে ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ সমাজবাদী চিন্তার ধারক অধ্যাপক ছবিল দাস আর দ্বারিকা দাস লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান রাজা রামের দেওয়া সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে কী ধরনের একাগ্রচিত্ত পড়ুয়া ছিলেন ভগৎ সিং । ইতিহাস , রাজনীতি , অর্থনীতি , চিরায়ত সাহিত্যের এক বিশেষ পাঠক ছিলেন তিনি । আরাে জানা যায় , সাথী সুখদেব , ভগবতীচরণ ভােরা ও আরাে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ভগৎ সিং সেই সময়ে চাইকোভস্কি , ক্রপটুকিনের মতাে রাশিয়ার বিপ্লবীদের অনুসরণে স্টাডি সারকেল বা অধ্যয়নচক্র গড়ে তুলেছিলেন । ভগৎ সিং - রা যাতে তাঁদের চাহিদামতাে বইপত্র পড়ার সুযােগ পান , তার জন্যে লালা লাজপত রাইয়ের তৈরি লাহােরের সার্ভেন্টস অফ দ্য পিপলস সােসাইটি ওইসব বইপত্র কেনার ( যদি লাইব্রেরিতে না থাকে ) ব্যবস্থা করে দেয় । সাথী বিপ্লবী জীতেন্দ্রনাথ সান্যালের লেখা “ যে শহীদ মৃত্যুচিন্তাকে জয় করেছিল ’ নিবন্ধ থেকে ভগৎ সিংয়ের পুস্তকপ্রীতি সম্পর্কে নানা

অজানা তথ্য জানা যায় । বাংলার বিপ্লবীদের লেখার জন্যে সাথী বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত ও জীতেন্দ্রনাথ সান্যালের কাছে বাংলাভাষা শেখেন । ভগৎ সিং । এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা আছে ভগৎ সিংয়ের । জীতেন্দ্রনাথ সান্যালের লেখা থেকে আরাে জানা যায় যে ভগৎ সিং রাশিয়ার বিপ্লব আর সমাজতন্ত্র সংক্রান্ত বইয়ের বিশেষ ভক্ত ছিলেন । রাজনীতি ছাড়াও সমাজবাস্তবতার ভিত্তিতে লেখা সাহিত্যের প্রতিও যে ভগৎ সিংয়ের গভীর আকর্ষণ ছিল এর সব থেকে বড় প্রমাণ । তাঁর পড়া বইগুলি । চার্লস ডিকেন্স ছিল ভগৎ সিংয়ের প্রিয় লেখক । আপটন সিনক্লেয়ারের ‘ ক্রাই ফর জাস্টিস ’ , ‘ জাঙ্গল ’ , রিডের ‘ টেন ডেজ দ্যাট সুক দ্য ওয়ার্ল্ড , গাের্কির ‘ মাদার ’ , ওস্কার ওয়াইলডের ‘ ডেরা , স্টেপনিয়াকের ‘ বার্থ অফ রাশিয়ান ডেমােক্র্যাসি ’ - র মত'এই ধরনের বেশ কিছু বই ছিল তাঁর প্রিয় । ন্যাশনাল কলেজে পড়ার সময় থেকেই সব সময় তাঁর পকেটে বই । থাকত । যার ফলে পকেট ছিড়ে যেত । ভগৎ সিংয়ের মা বিদ্যাবতী কাউর এই জন্যে ভগৎ সিংকে একটু বকাবকি করতেন , কারণ প্রায়শই তাকে জামার ভেঁড়া পকেট সেলাই করতে হতাে । ছেড়া পকেটওয়ালা জামা পরে ছেলেকে ঘােরাঘুরি করতে কোন মাই - বা দেখতে চান । “ আমি কেন একজন নাস্তিক ’ নামের ভগৎ সিংয়ের বিখ্যাত লেখাটির পিছনে আছে ক্ৰপকিনের ‘ মেমােয়ার ’ ও বাকুনিনের লেখা বইগুলি পড়ার প্রত্যক্ষ প্রভাব । সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের ওপর বইগুলি পড়ার পর থেকেই ভগৎ সিং অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন শুরু করেন , বাকি জীবনে সেই ধারাটি বজায় রাখেন । বিভিন্ন আদালতে দেওয়া সাড়া জাগানাে ঐতিহাসিক বক্তব্যগুলি তার বহু বইপত্র পড়ার প্রত্যক্ষ ফল বলা চলে ।

ভগৎ সিং ও তাঁর সাথীরা ধরা পড়ার পর আগ্রা , সাহারানপুরে তাঁদের বিপ্লবী কাজকর্মের কেন্দ্রগুলিতে পুলিস হানা দিয়ে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক বইপত্র পায় যার বেশিরভাগই হয় রাজনীতি , নতুবা বিপ্লব সংক্রান্ত । পড়াশােনা করা , পড়া বিষয়টি নিয়ে সাথীদের সাথে আলােচনা করার কর্মসূচীটি চালু করেন শহীদ - ই আজম সর্দার ভগৎ সিং । 



সম্ভবত তাঁর পড়াশােনার সেরা নিদর্শন হলাে ‘ জেল নােটবুক ’ যেটি ফাঁসির আগে বিচার চলার সময় বছর দুয়েক লাহাের সেন্ট্রাল জেলে থাকাকালে ভগৎ সিং লিখেছিলেন । জেলের মধ্যে নানা নির্যাতনের শিকার হয়েও অনশনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক বন্দীদের মানবিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কিছুটা সফল হয়েছিলেন শহীদ ভগৎ সিং আর তাঁর সাথীরা । এর ফলে জেলকোড মান্য করে বইপত্র পড়ার , চিঠিপত্র লেখার অধিকার পান তাঁরা । জেল থেকে শহীদ ভগৎ সিং যে সব চিঠি লিখতেন তার প্রত্যেকটিতে বইয়ের তালিকা থাকত । লাহােরের দ্বারিকা দাস লাইব্রেরি থেকে বই আনা হতাে । ১৯৩০ সালের ২৪ শে জুলাই বন্ধু জয়দেবকে একটি চিঠিতে শহীদ ভগৎ সিং লিখছেন ; 

“ দ্বারিকা দাস লাইব্রেরি থেকে নিচের বইগুলাে আমার নামে নিয়ে নিও আর শনিবার । দিন কুলবীরের ( ছােটভাই ) হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিও প্লিজ । 

( ১ ) মিলিটারিজিম ( লেখক কার্ল লিবনিচ ) , ( ২ ) হােয়াই মেন ফাইট ( লেখক , বাট্রান্ড রাসেল ) , ( ৩ ) সােভিয়েত অ্যাট ওয়ার , ( ৪ ) কোলাপস অফ দ্য সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল ( লেখক ,লেনিন ) , ( ৫ ) লেফট উইং কমিউনিজম ( লেখক , লেনিন ) , ( ৬ ) মিউচ্যুয়াল এন্ড ( লেখক , প্রিন্স ক্রপটুরিনেপ ) , ( ৭ ) ফিল্ড , ফ্যাক্টরিস এন্ড ওয়ার্কশপস , ( ৮ ) সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স ( লেখক কার্ল মার্কস ) , ( ৯ ) ল্যান্ড রিভােলিউশন ইন রাশিয়া , ( ১০ ) স্পাই ( লেখক আপটন সিনক্লিয়ার ) ।


 ‘ থিয়ােরি অফ হিস্টোরিক্যাল মেটিরিয়ালিজম বইটি যাতে আমি পাই তার ব্যবস্থা করাে কিন্তু । ” 

এই চিঠিতেই ডারলিংয়ের লেখা ‘ দ্য পাঞ্জাব পিজেন্ট ইন প্রসপারিটি এন্ড ডেট ’ এবং এই জাতীয় দু - একখানা বই চেয়ে পাঠাচ্ছেন ওই জেলে বন্দী থাকা লাহােরের কংগ্রেস নেতা ডাঃ আলমের জন্যে ।


 বলাই বাহুল্য , জেলে পড়া বইগুলাের বেশিরভাগই ছিল রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর , বিশেষ করে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের ওপর লেখা । স্বভাবতই বইগুলাের সিংহভাগই ছিল । মার্কস , লেনিন , ও এঙ্গেলসের লেখা । সাহিত্য , অন্যান্য দর্শনের ওপর বইও পড়েছেন প্রচুর । এই সব বইয়ের লেখকদের মধ্যে যেমন দেকার্তে , মেকিয়াভেলি , স্পিনােজার মতাে দার্শনিকরা আছেন , তেমনি আছেন লর্ড বায়রন , মার্ক টোয়েন , ওয়ার্ডসওয়ার্থ , রুশাের মতাে সাহিত্যিকরাও । আছেন মদনমােহন মালব্য , বিপিনচন্দ্র পাল , রবীন্দ্রনাথ , ওমর খৈয়াম প্রমুখ । ভগৎ সিংয়ের ‘ জেল নােটবুক ’ - এ ১০৮ জন লেখকের ও ৪৩ টি বই থেকে নেওয়া উদ্ধৃতি আছে । একই বই ও একই লেখকের একাধিক উদ্ধৃতি আছে এই জেল নােটবুকে । উদ্ধৃতির সংখ্যা এবং উদ্ভূত পরিসংখ্যানের সংখ্যা মােট ২৪৭ টি । নােটগুলি মূলত উদ্ধৃতি হলেও এই জেল নােটবইয়ে একটি মৌলিক বিষয়ে ভগৎ সিংয়ের নিজস্ব ভাবনা লিপিবদ্ধ আছে । বিষয়টির শিরােনাম দেওয়া হয়েছে ‘ সায়েন্স অফ স্টেট । ১৬৫ নং থেকে ১৭৬ নং পৃষ্ঠা পর্যন্ত অর্থাৎ ১২ পৃষ্ঠা ব্যাপী এই নােটটি । মনে হয় , রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে কোনাে বড়সড় লেখার বা বই লেখার কথা ভাবছিলেন তিনি । এই নােটটিতে বিভিন্ন লেখকের উদ্ধৃতির সাহায্যে আদিম যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সরকারের উৎপত্তি ও বিবর্তনের রূপরেখাটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে ।

ভগৎ সিংয়ের জেল নােটবুকটি কতকগুলি এলােমেলাে উদ্ধতির সমাবেশ মাত্র নয় । আর তাই যদি হতাে , তা হলে এই জেল নােটবুক নিয়ে আজ এত আলােচনা , এত আগ্রহের সৃষ্টি হতাে না । শুধু যত্ন করে লেখাই নয় , খুবই যত্ন নিয়ে নির্বাচনও করা হয়েছে উদ্ধৃতিগুলির । জেল নােটবুকে সযত্নে লেখা হয়েছে সেই সব উদ্ধৃতিগুলি যেগুলি তার আদর্শের সঙ্গে মেলে । অনায়াসে বলা যেতে পারে , উদ্ধৃতিগুলি রাষ্ট্র , সরকার , সমাজতন্ত্র , সর্বহারার একনায়কত্ব , জনগণের শক্তি ও স্বাধীনতা , বিপ্লব , ধর্ম , ব্যক্তি , পরিবার ইত্যাদি সম্পর্কে শহীদ ভগৎ সিংয়ের স্বচ্ছ চিন্তাভাবনার প্রতিফলন । জেল নােটবুকটি যেন তাঁর অসামান্য বিপ্লবী সত্তার প্রতিবিম্ব । ভগৎ সিং নিজেই বলেছেন , “ এই উদ্ধৃতি সংগ্রহের মধ্য দিয়ে ফাঁসির মঞ্চে শহীদ হওয়ার শেষদিন পর্যন্ত বিপ্লবী চেতনাকে সজাগ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে চাই । পাশাপাশি , চালিয়ে যেতে চাই চেতনার মান ক্রমাগত উন্নত করার প্রক্রিয়াটিকেও যা কিনা একজন সাচ্চা বিপ্লবীর কর্তব্য । ” 



যিনি সমাজতন্ত্রের সপক্ষে ধ্বনি তােলেন , ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দেন , তিনি যে মার্কস , এঙ্গেলস , লেনিনের লেখা থেকে সব থেকে বেশি উদ্ধৃতি দেবেন , সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে । । ঘটেছেও তাই । রাষ্ট্র , পরিবার , ব্যক্তিগত সম্পত্তি , সর্বহারার একনায়কত্ব , সামন্ততন্ত্র , পুঁজিবাদ ইত্যাদি বিষয়ক সম্পর্কে জেল নােটবুকে এই সব মহান বিপ্লবীদের উদ্ধৃতির সংখ্যা সব । থেকে বেশি । পরাধীন একটা দেশে বিপ্লবের জন্যে নিবেদিত প্রাণ একজন সাচ্চা বিপ্লবী যে বিপ্লবের নানান দিক নিয়ে অনুসন্ধান চালাবেন সেটাই তাে স্বাভাবিক । শহীদ ভগৎ সিংয়ের ক্ষেত্রে হয়েছেও তাই । মার্কস , এঙ্গেলস , লেনিনের লেখা থেকে অজস্র উদ্ধৃতি তাে আছেই । পাশাপাশি , অন্যান্য অনেক বিপ্লবীর ও প্রগতিশীল ব্যক্তির উদ্ধৃতিও আছে । বিপ্লবের বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতকে উপলব্ধি করতে হলে তত্ত্ব সম্পর্কিত গোঁড়ামির বদলে উদারতার প্রয়ােজন , সে বিষয়ে ভগৎ সিং সম্ভবত ভালােরকমই ওয়াকিবহাল ছিলেন । 

জেল নােটবুকের ৪৪ নং পৃষ্ঠায় আলফ্রেড বাটনের ‘ ওয়ার্ড হিস্টিরি অব ওয়ার্কার্স বইটি থেকে বড়সড় একটা উদ্ধৃতি বিপ্লব এবং শ্রেণীসমূহ ( Revolution and Classes ) শিরােনাম দিয়ে লেখা হয়েছে । তেমনি ৪৭ পৃষ্ঠায় কার্ল কাউটস্কির একটা উদ্ধৃতি ‘ বিপ্লব কথাটির সংজ্ঞা ( Term “ Revolution ” defined ) নাম দিয়ে লেখা হয়েছে , “ বিপ্লবের ধারণাটি পুলিসের ব্যাখ্যা অনুসারে সশস্ত্র বিদ্রোহ হিসেবে মেনে নেওয়া চলবে না ।... একটা পার্টিকে পাগলই বলা হবে যদি তার কাছে অন্যান্য কম ত্যাগসম্পন্ন এবং নিরাপদতর কার্যক্রম । গ্রহণের সুযােগ থাকা সত্ত্বেও সশস্ত্র বিদ্রোহকে নীতিগতভাবে বেছে নেয় ।... ” 


একজন বিপ্লবীর আশু লক্ষ্য হলাে নিজের দেশে বিপ্লব ঘটানাে । কিন্তু সাচ্চা বিপ্লবীদের থাকে একটা বিশ্বদর্শন । তার থাকে একটা বিশ্ববীক্ষা । সমাজকে উন্নত স্তরে নিয়ে যেতে হলে আগামী দিনে ঘটাতে হবে বিশ্ববিপ্লব । এই উপলব্ধিতে বলীয়ান ছিলেন বলেই শহীদ ভগৎ সিং বুখারিনের কথাটি ‘ বিশ্ব বিপ্লবের লক্ষ্য ’ শিরােনাম দিয়ে লিখেছেন ( ৫৭ পৃষ্ঠা ) ... ” ( ১ ) ধনতন্ত্রকে ভূপতিত করা , ( ২ ) মানুষের স্বার্থে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা । ”



বিপ্লবের জন্যে কী ধরনের পার্টির প্রয়ােজন সে কথাটি জেল নােটবুকে দেওয়া ‘ পার্টি ’ শিরােনামের তলায় ট্রটস্কির ‘ লেসনস অব রিভলিউশন ’ বইটি থেকে নেওয়া দু’টি উদ্ধৃতি থেকে বােঝা যায় ( ৬৪ নং পৃষ্ঠা ) ... ” এটা এখন পরিষ্কার যে , কোনাে বিপ্লবই সম্ভব নয় যদি না বিপ্লবকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতাে পার্টি থাকে । ” এবং “ সর্বহারার বিপ্লবের জন্যে একটা পার্টি হলাে অপরিহার্য হাতিয়ার । ”

 পরাধীন ভারতে একজন বিপ্লবীর প্রধান কাজই ছিল সমাজ কাঠামাে বদলানাের লক্ষ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে সংগ্রাম করা । আত্মত্যাগে শপথবদ্ধ শহীদ ভগৎ সিংয়ের মতাে বিপ্লবী সে কাজ করতে গিয়েই জীবনদান করেছেন । তাই দেখা যায় , তাঁর লেখা নােটবুকে ফ্রিডম বা স্বাধীনতা সম্পর্কে বেশ কয়েকটি উদ্ধৃতি রয়েছে যেগুলি আসলে কবিতা বা কবিতার অংশ । বিখ্যাত ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘ ন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেনস অ্যান্ড লিবার্টি ’ কবিতাটির অংশবিশেষ ‘ ফাইট ফর ফ্রিডম ’ বা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম শিরােনাম দিয়ে নােটবুকে লেখা হয়েছে ( ২৫ নং পৃষ্ঠা ) । তেমনি রয়েছে স্বাধীনতার জন্যে প্রবল আকুতি নিয়ে লেখা মার্কিন কবি জেমস রাসেল লােয়েল ও ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতার অংশবিশেষ ( ১৯ নং ও ২০ নং পৃষ্ঠা ) । 


সকল ইংরেজই যে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরাজের ভারত শাসনকে সমর্থন করে না , এই বিষয়টি সম্ভবত শহীদ ভগৎ সিংয়ের বিশেষ মনােযােগ আকর্ষণ করেছিল । তাই জেল নােটবুকে দেখা যায় । সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী লেখক ড . রাদারফোর্ডের লেখা থেকে একটা উদ্ধৃতি ( ১৩ নং পৃষ্ঠা ) ... “ যে ভাবে ভারতে ব্রিটিশ শাসন চলছে সেটা বিশ্বের নিকৃষ্টতম ও সর্বাধিক অনৈতিক ব্যবস্থাসম্পন্ন সরকার একটি জাতি কর্তৃক অন্য একটিকে শােষণ । ” এটির শিরােনাম দেওয়া হয়েছে , ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ইন ইন্ডিয়া ’ বা ভারতে ব্রিটিশ শাসন । অর্থনীতির বিষয়েও যে শহীদ ভগৎ সিংয়ের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল তার প্রমাণ মেলে এই জেল নােটবুকে দেওয়া সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির নাগরিকদের মধ্যে আয় বন্টনের চিত্র থেকে । ভারতের মতাে দেশগুলিতে ইংরেজরাজের সাম্রাজ্যবাদী শাসন আর শােষণের ফলে এবং ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে যে আয় হয় , তার সিংহভাগ আত্মসাৎ করে ইংরেজ পুঁজিপতিরা । সেই তুলনায় খেটে খাওয়া ইংরেজরা পায় নামমাত্র । এই বিষয়ে একটি বড় মাপের হিসেব দেওয়া আছে জেল নােটবুকে । ( ১২৩ নং পৃষ্ঠা ) । আর আছে বেশ কিছু এই ধরনের পরিসংখ্যান । 

এসব ছাড়াও সমাজজীবনের নানা দিক জানার , বােঝার যে প্রবল আগ্রহ ছিল , তার প্রমাণ । ছড়িয়ে আছে এই জেল নােটবুকে লেখা বহু উদ্ধৃতিতে । শিক্ষানীতি , জীবনের লক্ষ্য , সত্য কী , বিবাহ , ধর্ম , নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে মূল্যবান উদ্ধৃতি আছে । আর আছে লর্ড টেনিসনের “ দ্য চার্জ অফ দ্য লাইট ব্রিগেড ' নামের বিখ্যাত কবিতা ও ‘ ইন্টারন্যাশনাল ’ গীতিকবিতার পুরােটাই । বলাই বাহুল্য , উদ্ধৃত হয়েছে আরাে এমন অনেক উদীপ্তকারী কবিতা , হয় অংশ বিশেষ , নয় তাে পুরােটাই ।



এই জেল নােটবুকটি পড়ুয়া ভগৎ সিংয়ের এক অসামান্য সৃষ্টি । এক অসামান্য ঐতিহাসিক দলিলও বটে । শহীদ ভগৎ সিংয়ের বিপ্লবী চিন্তাধারা , আর মানসিকতা কত উন্নত , কত বলিষ্ঠ ছিল তার প্রমাণ এই জেল নােটবুক । এমনটি না হলে , ফাঁসির দিনক্ষণ স্থির হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও জেল নােটবুকে উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি লিখে যাওয়া সম্ভব হতাে না । শুধু একটাই অপূর্ণতা রয়ে গেছে । এই জেল নােটবুকে । উদ্ধৃতিগুলি নিচে কোন তারিখ না থাকায় ঠিক কবে , কোন উদ্ধৃতি লেখা হয়েছে সেটা বােঝা যায় না । 



ফাঁসি হবে জেনেও বিপ্লবী চেতনাকে সজাগ , সজীব করে রাখার স্বার্থে এই জেল নােটবুক লিখতে শুরু করেন শহীদ ভগৎ সিং । উদ্ধৃত বিষয়গুলি নিয়ে জেলের অন্যান্য সাথীদের সঙ্গে আলােচনাও হতাে তাঁদের চেতনাকে সজাগ করে রাখার লক্ষ্যে । আরাে একটা উদ্দেশ্য ছিল । যে সব সাথীরা কারাদণ্ড ভােগ করে একদিন মুক্ত হবে তাঁরা যাতে আরাধ্য কাজকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন । কত সমৃদ্ধ চিন্তাভাবনার অধিকারী হলে একাজ করা সম্ভব । 

শহীদ ভগৎ সিং শুধু একজন স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি সমাজটাকে বৈষম্যমুক্ত , বঞ্চনামুক্ত করতে চেয়েছিলেন । চেয়েছিলেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে । আর এই কাজে অধ্যয়নকে অর্থাৎ পড়াশােনা করাটাকে করে তুলেছিলেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের এক অপরিহার্য হাতিয়ার । সেইজন্যই তাে আজো শহীদ ভগৎ সিংকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে এক অনন্য বিপ্লবী হিসেবে ।


--- জলধর মল্লিক (লেখক)


🙏 লেখা সংগৃহীত 🙏

No comments:

Post a Comment

Your Comments help us a lot

EVERY THINK ONLINE EXAM 2

EVERY THINK ONLINE EXAM 2 Click Here.....👇👇👇👇👇 https://forms.gle/bEG4wTic8EMdK2eL6

Post Top Ad