ভগৎ সিং একজন মনোযোগী পড়ুয়া ছিলেন
বড়মাপের বিপ্লবী হতে হলে যেমন চাই যে কোনাে অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে সংগঠন গড়ে তােলার অপরিসীম ক্ষমতা , তেমনি থাকা চাই এমন একটা আদর্শ যা কিনা শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে বঞ্চনামুক্ত সমাজ গড়ে তােলার সঠিক পথ দেখাতে পারে । সকলেই জানেন , সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী শহীদ সর্দার ভগৎ সিং ছিলেন অশেষ সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী । ভারতের শ্রমজীবী মানুষকে ভগৎ সিং সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখান , ভারতের বুকে সাথীদের নিয়ে তিনিই প্রথম ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দেন । ২৪ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৩১ সালের ২৩ শে মার্চ যাঁকে ব্রিটিশরাজের ফাঁসির মঞ্চে শহীদ হতে হলাে , তারপক্ষে ওই সময়ে এমন একটা আদর্শকে গ্রহণ করা , এমন একটা স্লোগান দেওয়াটা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না । তাহলে এই ঐতিহাসিক কাজটি ভগৎ সিংয়ের পক্ষে কীভাবে করা সম্ভব হলাে ? পারিবারিক পরিমণ্ডল , জীবনবােধ , দেশের প্রতি ভালবাসা , পরাধীন দেশবাসীর জন্য অসীম দরদ , সাথীদের সাহচর্য , কয়েকজন বিপ্লবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক , কিছু ঘটনা- এসব যেমন ভগৎ সিংকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে এক অসাধারণ বিপ্লবী হয়ে উঠতে , তেমনি পাশাপাশি তাঁর আদর্শের ভিত্তিভূমি গড়ে তুলতে বিপুলভাবে সাহায্য করেছে নানা ধরনের প্রগতিশীল বই , সাময়িকপত্র , সংবাদপত্র ।
সত্যি কথা বলতে কী , শহীদ ভগৎ সিংয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে যতটা আলাপ - আলােচনা হয় , প্রায় ততটাই অনালােচিত থেকে যায় তাঁর পড়াশােনার কথা । ভগৎ সিং ছিলেন এক অনন্য সাধারণ একনিষ্ঠ এবং মনােযােগী পড়ুয়া । তাঁর জীবনচর্চা অন্তত সেকথাই প্রমাণ করে ।
গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শ্রেণীর পাঠ সফলভাবে সাঙ্গ করার পর তাঁর বাবা সর্দার কিষেন সিং উচ্চতর পড়াশােনার জন্য ভগৎ সিংকে লাহােরে পাঠান । আর্যসমাজীদের ডি এ ভি স্কুল ছেড়ে বিখ্যাত স্বাধীনতা - সংগ্রামী লালা লাজপত রাইয়ের প্রতিষ্ঠা করা লাহােরের ন্যাশনাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ভগৎ সিং ক্রমশ হয়ে ওঠেন প্রগতিশীল বইপত্রের একজন অত্যন্ত মনােযােগী পড়ুয়া । ১৭/১৮ বছর বয়সের এক তরুণ তখন ভগৎ সিং । ন্যাশনাল কলেজের লাইব্রেরি আর লালা লাজপত রায়ের সহকর্মী স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা দ্বারিকা দাসের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত লাহােরের দ্বারিকা দাস লাইব্রেরি ভগৎ সিংয়ের বইপত্র পড়ার অভ্যাসটি গড়ে তুলতে বিশেষভাবে সাহায্য করে । আদালতে ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ সমাজবাদী চিন্তার ধারক অধ্যাপক ছবিল দাস আর দ্বারিকা দাস লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান রাজা রামের দেওয়া সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে কী ধরনের একাগ্রচিত্ত পড়ুয়া ছিলেন ভগৎ সিং । ইতিহাস , রাজনীতি , অর্থনীতি , চিরায়ত সাহিত্যের এক বিশেষ পাঠক ছিলেন তিনি । আরাে জানা যায় , সাথী সুখদেব , ভগবতীচরণ ভােরা ও আরাে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ভগৎ সিং সেই সময়ে চাইকোভস্কি , ক্রপটুকিনের মতাে রাশিয়ার বিপ্লবীদের অনুসরণে স্টাডি সারকেল বা অধ্যয়নচক্র গড়ে তুলেছিলেন । ভগৎ সিং - রা যাতে তাঁদের চাহিদামতাে বইপত্র পড়ার সুযােগ পান , তার জন্যে লালা লাজপত রাইয়ের তৈরি লাহােরের সার্ভেন্টস অফ দ্য পিপলস সােসাইটি ওইসব বইপত্র কেনার ( যদি লাইব্রেরিতে না থাকে ) ব্যবস্থা করে দেয় । সাথী বিপ্লবী জীতেন্দ্রনাথ সান্যালের লেখা “ যে শহীদ মৃত্যুচিন্তাকে জয় করেছিল ’ নিবন্ধ থেকে ভগৎ সিংয়ের পুস্তকপ্রীতি সম্পর্কে নানা
অজানা তথ্য জানা যায় । বাংলার বিপ্লবীদের লেখার জন্যে সাথী বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত ও জীতেন্দ্রনাথ সান্যালের কাছে বাংলাভাষা শেখেন । ভগৎ সিং । এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা আছে ভগৎ সিংয়ের । জীতেন্দ্রনাথ সান্যালের লেখা থেকে আরাে জানা যায় যে ভগৎ সিং রাশিয়ার বিপ্লব আর সমাজতন্ত্র সংক্রান্ত বইয়ের বিশেষ ভক্ত ছিলেন । রাজনীতি ছাড়াও সমাজবাস্তবতার ভিত্তিতে লেখা সাহিত্যের প্রতিও যে ভগৎ সিংয়ের গভীর আকর্ষণ ছিল এর সব থেকে বড় প্রমাণ । তাঁর পড়া বইগুলি । চার্লস ডিকেন্স ছিল ভগৎ সিংয়ের প্রিয় লেখক । আপটন সিনক্লেয়ারের ‘ ক্রাই ফর জাস্টিস ’ , ‘ জাঙ্গল ’ , রিডের ‘ টেন ডেজ দ্যাট সুক দ্য ওয়ার্ল্ড , গাের্কির ‘ মাদার ’ , ওস্কার ওয়াইলডের ‘ ডেরা , স্টেপনিয়াকের ‘ বার্থ অফ রাশিয়ান ডেমােক্র্যাসি ’ - র মত'এই ধরনের বেশ কিছু বই ছিল তাঁর প্রিয় । ন্যাশনাল কলেজে পড়ার সময় থেকেই সব সময় তাঁর পকেটে বই । থাকত । যার ফলে পকেট ছিড়ে যেত । ভগৎ সিংয়ের মা বিদ্যাবতী কাউর এই জন্যে ভগৎ সিংকে একটু বকাবকি করতেন , কারণ প্রায়শই তাকে জামার ভেঁড়া পকেট সেলাই করতে হতাে । ছেড়া পকেটওয়ালা জামা পরে ছেলেকে ঘােরাঘুরি করতে কোন মাই - বা দেখতে চান । “ আমি কেন একজন নাস্তিক ’ নামের ভগৎ সিংয়ের বিখ্যাত লেখাটির পিছনে আছে ক্ৰপকিনের ‘ মেমােয়ার ’ ও বাকুনিনের লেখা বইগুলি পড়ার প্রত্যক্ষ প্রভাব । সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের ওপর বইগুলি পড়ার পর থেকেই ভগৎ সিং অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন শুরু করেন , বাকি জীবনে সেই ধারাটি বজায় রাখেন । বিভিন্ন আদালতে দেওয়া সাড়া জাগানাে ঐতিহাসিক বক্তব্যগুলি তার বহু বইপত্র পড়ার প্রত্যক্ষ ফল বলা চলে ।
ভগৎ সিং ও তাঁর সাথীরা ধরা পড়ার পর আগ্রা , সাহারানপুরে তাঁদের বিপ্লবী কাজকর্মের কেন্দ্রগুলিতে পুলিস হানা দিয়ে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক বইপত্র পায় যার বেশিরভাগই হয় রাজনীতি , নতুবা বিপ্লব সংক্রান্ত । পড়াশােনা করা , পড়া বিষয়টি নিয়ে সাথীদের সাথে আলােচনা করার কর্মসূচীটি চালু করেন শহীদ - ই আজম সর্দার ভগৎ সিং ।
সম্ভবত তাঁর পড়াশােনার সেরা নিদর্শন হলাে ‘ জেল নােটবুক ’ যেটি ফাঁসির আগে বিচার চলার সময় বছর দুয়েক লাহাের সেন্ট্রাল জেলে থাকাকালে ভগৎ সিং লিখেছিলেন । জেলের মধ্যে নানা নির্যাতনের শিকার হয়েও অনশনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক বন্দীদের মানবিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কিছুটা সফল হয়েছিলেন শহীদ ভগৎ সিং আর তাঁর সাথীরা । এর ফলে জেলকোড মান্য করে বইপত্র পড়ার , চিঠিপত্র লেখার অধিকার পান তাঁরা । জেল থেকে শহীদ ভগৎ সিং যে সব চিঠি লিখতেন তার প্রত্যেকটিতে বইয়ের তালিকা থাকত । লাহােরের দ্বারিকা দাস লাইব্রেরি থেকে বই আনা হতাে । ১৯৩০ সালের ২৪ শে জুলাই বন্ধু জয়দেবকে একটি চিঠিতে শহীদ ভগৎ সিং লিখছেন ;
“ দ্বারিকা দাস লাইব্রেরি থেকে নিচের বইগুলাে আমার নামে নিয়ে নিও আর শনিবার । দিন কুলবীরের ( ছােটভাই ) হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিও প্লিজ ।
( ১ ) মিলিটারিজিম ( লেখক কার্ল লিবনিচ ) , ( ২ ) হােয়াই মেন ফাইট ( লেখক , বাট্রান্ড রাসেল ) , ( ৩ ) সােভিয়েত অ্যাট ওয়ার , ( ৪ ) কোলাপস অফ দ্য সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল ( লেখক ,লেনিন ) , ( ৫ ) লেফট উইং কমিউনিজম ( লেখক , লেনিন ) , ( ৬ ) মিউচ্যুয়াল এন্ড ( লেখক , প্রিন্স ক্রপটুরিনেপ ) , ( ৭ ) ফিল্ড , ফ্যাক্টরিস এন্ড ওয়ার্কশপস , ( ৮ ) সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স ( লেখক কার্ল মার্কস ) , ( ৯ ) ল্যান্ড রিভােলিউশন ইন রাশিয়া , ( ১০ ) স্পাই ( লেখক আপটন সিনক্লিয়ার ) ।
‘ থিয়ােরি অফ হিস্টোরিক্যাল মেটিরিয়ালিজম বইটি যাতে আমি পাই তার ব্যবস্থা করাে কিন্তু । ”
এই চিঠিতেই ডারলিংয়ের লেখা ‘ দ্য পাঞ্জাব পিজেন্ট ইন প্রসপারিটি এন্ড ডেট ’ এবং এই জাতীয় দু - একখানা বই চেয়ে পাঠাচ্ছেন ওই জেলে বন্দী থাকা লাহােরের কংগ্রেস নেতা ডাঃ আলমের জন্যে ।
বলাই বাহুল্য , জেলে পড়া বইগুলাের বেশিরভাগই ছিল রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর , বিশেষ করে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের ওপর লেখা । স্বভাবতই বইগুলাের সিংহভাগই ছিল । মার্কস , লেনিন , ও এঙ্গেলসের লেখা । সাহিত্য , অন্যান্য দর্শনের ওপর বইও পড়েছেন প্রচুর । এই সব বইয়ের লেখকদের মধ্যে যেমন দেকার্তে , মেকিয়াভেলি , স্পিনােজার মতাে দার্শনিকরা আছেন , তেমনি আছেন লর্ড বায়রন , মার্ক টোয়েন , ওয়ার্ডসওয়ার্থ , রুশাের মতাে সাহিত্যিকরাও । আছেন মদনমােহন মালব্য , বিপিনচন্দ্র পাল , রবীন্দ্রনাথ , ওমর খৈয়াম প্রমুখ । ভগৎ সিংয়ের ‘ জেল নােটবুক ’ - এ ১০৮ জন লেখকের ও ৪৩ টি বই থেকে নেওয়া উদ্ধৃতি আছে । একই বই ও একই লেখকের একাধিক উদ্ধৃতি আছে এই জেল নােটবুকে । উদ্ধৃতির সংখ্যা এবং উদ্ভূত পরিসংখ্যানের সংখ্যা মােট ২৪৭ টি । নােটগুলি মূলত উদ্ধৃতি হলেও এই জেল নােটবইয়ে একটি মৌলিক বিষয়ে ভগৎ সিংয়ের নিজস্ব ভাবনা লিপিবদ্ধ আছে । বিষয়টির শিরােনাম দেওয়া হয়েছে ‘ সায়েন্স অফ স্টেট । ১৬৫ নং থেকে ১৭৬ নং পৃষ্ঠা পর্যন্ত অর্থাৎ ১২ পৃষ্ঠা ব্যাপী এই নােটটি । মনে হয় , রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে কোনাে বড়সড় লেখার বা বই লেখার কথা ভাবছিলেন তিনি । এই নােটটিতে বিভিন্ন লেখকের উদ্ধৃতির সাহায্যে আদিম যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সরকারের উৎপত্তি ও বিবর্তনের রূপরেখাটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে ।
ভগৎ সিংয়ের জেল নােটবুকটি কতকগুলি এলােমেলাে উদ্ধতির সমাবেশ মাত্র নয় । আর তাই যদি হতাে , তা হলে এই জেল নােটবুক নিয়ে আজ এত আলােচনা , এত আগ্রহের সৃষ্টি হতাে না । শুধু যত্ন করে লেখাই নয় , খুবই যত্ন নিয়ে নির্বাচনও করা হয়েছে উদ্ধৃতিগুলির । জেল নােটবুকে সযত্নে লেখা হয়েছে সেই সব উদ্ধৃতিগুলি যেগুলি তার আদর্শের সঙ্গে মেলে । অনায়াসে বলা যেতে পারে , উদ্ধৃতিগুলি রাষ্ট্র , সরকার , সমাজতন্ত্র , সর্বহারার একনায়কত্ব , জনগণের শক্তি ও স্বাধীনতা , বিপ্লব , ধর্ম , ব্যক্তি , পরিবার ইত্যাদি সম্পর্কে শহীদ ভগৎ সিংয়ের স্বচ্ছ চিন্তাভাবনার প্রতিফলন । জেল নােটবুকটি যেন তাঁর অসামান্য বিপ্লবী সত্তার প্রতিবিম্ব । ভগৎ সিং নিজেই বলেছেন , “ এই উদ্ধৃতি সংগ্রহের মধ্য দিয়ে ফাঁসির মঞ্চে শহীদ হওয়ার শেষদিন পর্যন্ত বিপ্লবী চেতনাকে সজাগ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে চাই । পাশাপাশি , চালিয়ে যেতে চাই চেতনার মান ক্রমাগত উন্নত করার প্রক্রিয়াটিকেও যা কিনা একজন সাচ্চা বিপ্লবীর কর্তব্য । ”
যিনি সমাজতন্ত্রের সপক্ষে ধ্বনি তােলেন , ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দেন , তিনি যে মার্কস , এঙ্গেলস , লেনিনের লেখা থেকে সব থেকে বেশি উদ্ধৃতি দেবেন , সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে । । ঘটেছেও তাই । রাষ্ট্র , পরিবার , ব্যক্তিগত সম্পত্তি , সর্বহারার একনায়কত্ব , সামন্ততন্ত্র , পুঁজিবাদ ইত্যাদি বিষয়ক সম্পর্কে জেল নােটবুকে এই সব মহান বিপ্লবীদের উদ্ধৃতির সংখ্যা সব । থেকে বেশি । পরাধীন একটা দেশে বিপ্লবের জন্যে নিবেদিত প্রাণ একজন সাচ্চা বিপ্লবী যে বিপ্লবের নানান দিক নিয়ে অনুসন্ধান চালাবেন সেটাই তাে স্বাভাবিক । শহীদ ভগৎ সিংয়ের ক্ষেত্রে হয়েছেও তাই । মার্কস , এঙ্গেলস , লেনিনের লেখা থেকে অজস্র উদ্ধৃতি তাে আছেই । পাশাপাশি , অন্যান্য অনেক বিপ্লবীর ও প্রগতিশীল ব্যক্তির উদ্ধৃতিও আছে । বিপ্লবের বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতকে উপলব্ধি করতে হলে তত্ত্ব সম্পর্কিত গোঁড়ামির বদলে উদারতার প্রয়ােজন , সে বিষয়ে ভগৎ সিং সম্ভবত ভালােরকমই ওয়াকিবহাল ছিলেন ।
জেল নােটবুকের ৪৪ নং পৃষ্ঠায় আলফ্রেড বাটনের ‘ ওয়ার্ড হিস্টিরি অব ওয়ার্কার্স বইটি থেকে বড়সড় একটা উদ্ধৃতি বিপ্লব এবং শ্রেণীসমূহ ( Revolution and Classes ) শিরােনাম দিয়ে লেখা হয়েছে । তেমনি ৪৭ পৃষ্ঠায় কার্ল কাউটস্কির একটা উদ্ধৃতি ‘ বিপ্লব কথাটির সংজ্ঞা ( Term “ Revolution ” defined ) নাম দিয়ে লেখা হয়েছে , “ বিপ্লবের ধারণাটি পুলিসের ব্যাখ্যা অনুসারে সশস্ত্র বিদ্রোহ হিসেবে মেনে নেওয়া চলবে না ।... একটা পার্টিকে পাগলই বলা হবে যদি তার কাছে অন্যান্য কম ত্যাগসম্পন্ন এবং নিরাপদতর কার্যক্রম । গ্রহণের সুযােগ থাকা সত্ত্বেও সশস্ত্র বিদ্রোহকে নীতিগতভাবে বেছে নেয় ।... ”
একজন বিপ্লবীর আশু লক্ষ্য হলাে নিজের দেশে বিপ্লব ঘটানাে । কিন্তু সাচ্চা বিপ্লবীদের থাকে একটা বিশ্বদর্শন । তার থাকে একটা বিশ্ববীক্ষা । সমাজকে উন্নত স্তরে নিয়ে যেতে হলে আগামী দিনে ঘটাতে হবে বিশ্ববিপ্লব । এই উপলব্ধিতে বলীয়ান ছিলেন বলেই শহীদ ভগৎ সিং বুখারিনের কথাটি ‘ বিশ্ব বিপ্লবের লক্ষ্য ’ শিরােনাম দিয়ে লিখেছেন ( ৫৭ পৃষ্ঠা ) ... ” ( ১ ) ধনতন্ত্রকে ভূপতিত করা , ( ২ ) মানুষের স্বার্থে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা । ”
বিপ্লবের জন্যে কী ধরনের পার্টির প্রয়ােজন সে কথাটি জেল নােটবুকে দেওয়া ‘ পার্টি ’ শিরােনামের তলায় ট্রটস্কির ‘ লেসনস অব রিভলিউশন ’ বইটি থেকে নেওয়া দু’টি উদ্ধৃতি থেকে বােঝা যায় ( ৬৪ নং পৃষ্ঠা ) ... ” এটা এখন পরিষ্কার যে , কোনাে বিপ্লবই সম্ভব নয় যদি না বিপ্লবকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতাে পার্টি থাকে । ” এবং “ সর্বহারার বিপ্লবের জন্যে একটা পার্টি হলাে অপরিহার্য হাতিয়ার । ”
পরাধীন ভারতে একজন বিপ্লবীর প্রধান কাজই ছিল সমাজ কাঠামাে বদলানাের লক্ষ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে সংগ্রাম করা । আত্মত্যাগে শপথবদ্ধ শহীদ ভগৎ সিংয়ের মতাে বিপ্লবী সে কাজ করতে গিয়েই জীবনদান করেছেন । তাই দেখা যায় , তাঁর লেখা নােটবুকে ফ্রিডম বা স্বাধীনতা সম্পর্কে বেশ কয়েকটি উদ্ধৃতি রয়েছে যেগুলি আসলে কবিতা বা কবিতার অংশ । বিখ্যাত ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘ ন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেনস অ্যান্ড লিবার্টি ’ কবিতাটির অংশবিশেষ ‘ ফাইট ফর ফ্রিডম ’ বা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম শিরােনাম দিয়ে নােটবুকে লেখা হয়েছে ( ২৫ নং পৃষ্ঠা ) । তেমনি রয়েছে স্বাধীনতার জন্যে প্রবল আকুতি নিয়ে লেখা মার্কিন কবি জেমস রাসেল লােয়েল ও ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতার অংশবিশেষ ( ১৯ নং ও ২০ নং পৃষ্ঠা ) ।
সকল ইংরেজই যে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরাজের ভারত শাসনকে সমর্থন করে না , এই বিষয়টি সম্ভবত শহীদ ভগৎ সিংয়ের বিশেষ মনােযােগ আকর্ষণ করেছিল । তাই জেল নােটবুকে দেখা যায় । সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী লেখক ড . রাদারফোর্ডের লেখা থেকে একটা উদ্ধৃতি ( ১৩ নং পৃষ্ঠা ) ... “ যে ভাবে ভারতে ব্রিটিশ শাসন চলছে সেটা বিশ্বের নিকৃষ্টতম ও সর্বাধিক অনৈতিক ব্যবস্থাসম্পন্ন সরকার একটি জাতি কর্তৃক অন্য একটিকে শােষণ । ” এটির শিরােনাম দেওয়া হয়েছে , ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ইন ইন্ডিয়া ’ বা ভারতে ব্রিটিশ শাসন । অর্থনীতির বিষয়েও যে শহীদ ভগৎ সিংয়ের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল তার প্রমাণ মেলে এই জেল নােটবুকে দেওয়া সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির নাগরিকদের মধ্যে আয় বন্টনের চিত্র থেকে । ভারতের মতাে দেশগুলিতে ইংরেজরাজের সাম্রাজ্যবাদী শাসন আর শােষণের ফলে এবং ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে যে আয় হয় , তার সিংহভাগ আত্মসাৎ করে ইংরেজ পুঁজিপতিরা । সেই তুলনায় খেটে খাওয়া ইংরেজরা পায় নামমাত্র । এই বিষয়ে একটি বড় মাপের হিসেব দেওয়া আছে জেল নােটবুকে । ( ১২৩ নং পৃষ্ঠা ) । আর আছে বেশ কিছু এই ধরনের পরিসংখ্যান ।
এসব ছাড়াও সমাজজীবনের নানা দিক জানার , বােঝার যে প্রবল আগ্রহ ছিল , তার প্রমাণ । ছড়িয়ে আছে এই জেল নােটবুকে লেখা বহু উদ্ধৃতিতে । শিক্ষানীতি , জীবনের লক্ষ্য , সত্য কী , বিবাহ , ধর্ম , নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে মূল্যবান উদ্ধৃতি আছে । আর আছে লর্ড টেনিসনের “ দ্য চার্জ অফ দ্য লাইট ব্রিগেড ' নামের বিখ্যাত কবিতা ও ‘ ইন্টারন্যাশনাল ’ গীতিকবিতার পুরােটাই । বলাই বাহুল্য , উদ্ধৃত হয়েছে আরাে এমন অনেক উদীপ্তকারী কবিতা , হয় অংশ বিশেষ , নয় তাে পুরােটাই ।
এই জেল নােটবুকটি পড়ুয়া ভগৎ সিংয়ের এক অসামান্য সৃষ্টি । এক অসামান্য ঐতিহাসিক দলিলও বটে । শহীদ ভগৎ সিংয়ের বিপ্লবী চিন্তাধারা , আর মানসিকতা কত উন্নত , কত বলিষ্ঠ ছিল তার প্রমাণ এই জেল নােটবুক । এমনটি না হলে , ফাঁসির দিনক্ষণ স্থির হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও জেল নােটবুকে উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি লিখে যাওয়া সম্ভব হতাে না । শুধু একটাই অপূর্ণতা রয়ে গেছে । এই জেল নােটবুকে । উদ্ধৃতিগুলি নিচে কোন তারিখ না থাকায় ঠিক কবে , কোন উদ্ধৃতি লেখা হয়েছে সেটা বােঝা যায় না ।
ফাঁসি হবে জেনেও বিপ্লবী চেতনাকে সজাগ , সজীব করে রাখার স্বার্থে এই জেল নােটবুক লিখতে শুরু করেন শহীদ ভগৎ সিং । উদ্ধৃত বিষয়গুলি নিয়ে জেলের অন্যান্য সাথীদের সঙ্গে আলােচনাও হতাে তাঁদের চেতনাকে সজাগ করে রাখার লক্ষ্যে । আরাে একটা উদ্দেশ্য ছিল । যে সব সাথীরা কারাদণ্ড ভােগ করে একদিন মুক্ত হবে তাঁরা যাতে আরাধ্য কাজকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন । কত সমৃদ্ধ চিন্তাভাবনার অধিকারী হলে একাজ করা সম্ভব ।
শহীদ ভগৎ সিং শুধু একজন স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি সমাজটাকে বৈষম্যমুক্ত , বঞ্চনামুক্ত করতে চেয়েছিলেন । চেয়েছিলেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে । আর এই কাজে অধ্যয়নকে অর্থাৎ পড়াশােনা করাটাকে করে তুলেছিলেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের এক অপরিহার্য হাতিয়ার । সেইজন্যই তাে আজো শহীদ ভগৎ সিংকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে এক অনন্য বিপ্লবী হিসেবে ।
--- জলধর মল্লিক (লেখক)
🙏 লেখা সংগৃহীত 🙏
No comments:
Post a Comment
Your Comments help us a lot